……..মোরশেদ আলম।
করোনার সংক্রমণের শুরুর দিকে যে ভয় ছিল, এখন তাই দৃশ্যমান। হ্যাঁ, বিশ্বব্যাপী পণ্যের ঘাটতি না থাকলেও করোনা প্রাদুর্ভাবে পরিবহন ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মারাত্মকভাবে, ফলে বিশৃংখলা দেখা দিয়েছে সরবরাহ ব্যবস্থায়। যার অনিবার্য পরিণতিতে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটতে যাচ্ছে ভোগ্যপণ্যসহ নানা পণ্যের।
বিশ্ব বাণিজ্যের মেরুদণ্ড হচ্ছে সমূদ্রপথে জাহাজের মাধ্যমে পণ্য সরবরাহ। বাংলাদেশের মতো আমদানী নির্ভর দেশে এই পরিবহন ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ খাদ্যপণ্য যেমন গম, ভুট্টা, চাল থেকে শুরু করে ভোগ্যপণ্য যেমন ভোজ্যতেল, ডাল, শিল্পের কেমিক্যাল উপকরণ, ইত্যাদি সবই আসে এই সমুদ্রপথে। ২০ ফুট এবং ৪০ ফুট কন্টেইনার অথবা মুক্ত আধারে জাহাজ ভর্তি করে আমদানী করা হয় পণ্য সামগ্রী। এই কন্টেইনারের ঘাটতি দেখা দিয়েছে অস্বাভাবিকভাবে। কারণ করোনাভাইরাসের উপস্থিতি।

করোনাভাইরাস মহামারীর ফলে বিশ্বের বৃহত্তম শিপিং লাইনগুলোর মাউন্টিং ব্যাকলগ অর্থাৎ পণ্য সরবরাহ করে উৎসে ফিরে গিয়ে আবার গন্তব্যে যাওয়ার সময় বিলম্বের মুখোমুখি হয়ে গেছে। ফলে আন্তর্জাতিক সরবরাহে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে করেছে যা বিশ্ব-বাণিজ্যকে ব্যাহত করার হুমকি দিচ্ছে। অপারেটররা বলছে, কন্টেইনার শিপিং ইন্ডাস্ট্রি-কর্মীদের অসুস্থতা, আইসোলেশন এবং সামাজিক দূরত্বের সংযুক্ত প্রভাবের কারণে গ্রাহকের চাহিদা বৃদ্ধি, লকডাউনের কারণে জাহাজ এবং বন্দরের পণ্য ওঠা-নামানোর যন্ত্রের পার্টস তৈরির কারখানায় উৎপাদনে বিঘ্ন সৃষ্টি ইত্যাদি কারণে সরবরাহ ব্যবস্থা গুরুতর চাপের মধ্যে রয়েছে।
বিশ্বের প্রথম শ্রেণীর কনটেইনার শিপ অপারেটররা জানায় যে, ক্রমবর্ধমান চাহিদার মিশ্রণ এবং লজিস্টিক সিস্টেমে ক্ষমতা হ্রাস করার ফলে বন্দরের টার্মিনালগুলোতে প্রচণ্ড বিশৃংখলতার সৃষ্টি হয়েছে। বন্দর পর্যন্ত পণ্য পৌঁছে দিতে এবং পণ্য খালাসের পর তা গন্তব্যে পৌঁছে দিতে প্রয়োজনীয় ট্রাক চালকের অভাব রয়েছে। এর কারণ হচ্ছে- করোনার কারণে কেউ কেউ গাড়ি চালাতে সক্ষম হন নি, এশিয়ার বাইরে এই অবস্থা অত্যন্ত প্রকট। এর ফলে জাহাজগুলোর পণ্য খালাসে যেমন সময় বেশী লাগছে, তেমনি পণ্য খালাসের পর তা নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে বেশি সময় লাগছে। আবার একটি জাহাজের পণ্য খালাসে সময় বেশী লাগলে অন্য জাহাজের জন্য আপেক্ষার সময় বেড়ে যাচ্ছে। ফলে প্রতিটি বন্দরে সৃষ্টি হচ্ছে চরম বিশৃংখলতা।

বিশ্লেষণে দেখা এক্সায়, জাহাজগুলো কয়েকটি ‘কী পোর্টে’ বার্থের জন্য অপেক্ষা করছে। সম্প্রতি একটি বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার মেরিন এক্সচেঞ্জ, দুটি ব্যস্ততম মার্কিন কনটেইনার বন্দর, লস অ্যাঞ্জেলেস এবং লং বিচ এর নোঙ্গরে ১৭টি জাহাজ বার্থের জন্য অপেক্ষা করছিল। একই দিন পরে আরও চারটি জাহাজ পৌঁছানোর কথা ছিল, যখন বন্দরে প্রবেশের জন্য তিনটি অপেক্ষামান ছিল। বন্দরটির অক্টোবর মাসের পরিসংখ্যানে পাওয়া যায়- গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় এক তৃতীয়াংশ বেশি কন্টেইনার গ্রহণ করেছে এ বন্দর।
প্রতিক্রিয়া হিসেবে শিপিং লাইনগুলো আদেশ বাতিল করছে এবং জাহাজগুলো ডাইভার্ট করছে। সিঙ্গাপুর বিশ্বের বৃহত্তম কনটেইনার হাব। এই বন্দরে মালামাল পৌঁছানোর পরিমাণ বিশ্লেষণে দেখা যায়- অক্টোবরে ৩১ শতাংশে পৌঁছেছে, গত বছরের একই সময়ে ২১ শতাংশ ছিল। বিশ্বের প্রথম শ্রেণীর কন্টেইনার শিপিং সংস্থাগুলো জানায় “পুরো সরবরাহ চেইন চাপের মধ্যে রয়েছে, বাজার পরিস্থিতি অসাধারণ।” কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবে দ্রুত বহুসংখ্যক কর্মীকে আলাদা করতে বাধ্য করেছে যা বন্দর টার্মিনালের উৎপাদনশীলতা দ্রুতগতিতে বিঘ্নিত করেছে। এমনও উদাহরণ রয়েছে যে, যেখানে একটি বন্দরে ৬০০ বন্দর-কর্মীকে আলাদা করে রাখা হয়েছিল যখন সেই বন্দরটি তার কার্যক্রমের শীর্ষে ছিল এবং মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে সেখান থেকে পাশাপাশি সময়ে ছেড়ে যাওয়ার জন্য ১০টি জাহাজ দাঁড়িয়ে ছিল।
বন্দরে বিশৃংখলতা আর বিলম্বের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিপিং কোম্পানিগুলো, আর এই ক্ষতি পোষাতে ও চাহিদা বাড়ার কারণে তারা ভাড়া বাড়িয়ে দিচ্ছে। এই অতিরিক্ত ভাড়ার চাপ পড়ছে ক্রেতা তথা ভোক্তার ওপর। আমদানী পণ্য ভোক্তার হাতে পৌঁছাতে প্রায় ২-৩ মাস সময় লাগে, তাই ভোক্তা পর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধির আঁচ এখন না লাগলেও তা ভোক্তাকে অস্থির করবে খুব তাড়াতাড়ি।
করোনা মহামারি শুরুর পর থেকেই চাপ বাড়ছে শিপিং লাইনগুলোর উপর। ২০২০’র শুরুতে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে এবং বিশ্ব বাণিজ্য দ্রুত গতিতে সঙ্কুচিত হওয়ার সাথে সাথে শিপিং লাইনগুলো কয়েকশ নৌযান বাতিল করে দেয়। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বাণিজ্য যেমন নিজের অবস্থানে ফিরেছে করেছে, এশিয়া থেকে সরবরাহ করা পণ্যগুলোর চাহিদা বাড়ছে এবং লাইনগুলো সম্পূর্ণ ক্ষমতার কাছাকাছি চলে এসেছে। বিশেষতঃ এশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলে যাওয়ার খরচ সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বেড়ে যাচ্ছে এবং এখন ‘রেকর্ড শীর্ষে’ রয়েছে। আশার কথা- কিছু কিছু শিপিং লাইন সম্প্রতি কনটেইনারের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে, তবে তা সমূদ্র পরিবহন বাণিজ্যে কতটুকু সাহায্য করবে, তা সময় বলে দেবে।
(লেখক-সভাপতি, বাংলাদেশ এনিমেল এগ্রিকালচার সোসাইটি (BAAS)
ভারটেক্স নিউজ/এমএসআই/৭
মন্তব্য করুন